মেহেরপুর জেলার ঐতিহাসিক স্থান আমঝুপি বাজারের সন্নিকটে একটি ছোট গ্রাম, নাম হাসনাবাদ। ১৯৮৭ সালের ৪ মে এই গ্রামে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিকতা নিয়ে কৃষক মো. জামাত আলী ও নুরজাহানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন মোছা. লাইলী খাতুন। সে না পারতো ঠিকমতো চলতে, না পারতো ঠিকভাবে কথা বলতে; সাথে থেমে ছিল তার মানসিক বিকাশের স্বাভাবিক গতি। প্রতিবন্ধী হওয়ার ফলে সমাজ-সংসারে বহুবিধ উৎপীড়নের মাঝে ধীরে ধীরে লাইলী বড় হতে থাকে। বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিকতার কারণে আশেপাশের মানুষজনের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও হাসির খোরাক।
তৃতীয় শ্রেণীর বেশি লেখাপড়া করতে না পারা লাইলী সংসারের বোঝা হিসেবে ২৭ বছর পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করেন। ২০১৪ সাল থেকে লাইলী প্রতি তিন মাস অন্তর ১হাজার ৫শ টাকা করে সরকার প্রবর্তিত প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে থাকেন। টাকার পরিমাণ খুবই সামান্য হওয়ায় এ টাকা তার জীবনযাত্রায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। এমন সময় একদিন লাইলীর সাথে সাক্ষাৎ হয় ওয়েভ ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত ‘ফুড সিকিউরিটি ২০১২ বাংলাদেশ ইউপিপি-উজ্জীবিত প্রকল্প’র একজন কর্মকর্তার সাথে। পরবর্তীতে প্রকল্পের অধীনে লাইলীকে হাঁস-মুরগি পালনের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাকে কিছু হাঁস-মুরগি, কোয়েল পাখি, মাছ ও মাছ ধরার জাল প্রদান করা হয়। লাইলী এগুলো পালন করতে শুরু করেন, পাশাপাশি প্রতিবন্ধী তহবিলের টাকা দিয়ে প্রথমবারের মত ১টি মা ছাগল ক্রয় করেন। প্রথম বছরেই হাঁস-মুরগি, কোয়েল ও ছাগল বিক্রি করে লাইলী ৩৫ হাজার টাকা উপার্জন করেন। পরবর্তীতে এ টাকা ও পরিবারের সহযোগিতায় ৫০ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে বাড়ির পাশে একটি ছোট পুকুর ক্রয় করেন এবং বিভিন্ন ধরনের (সিলভার কার্প, মিরর কার্প, তেলাপিয়া) মাছ চাষ ও পরিচর্যা শুরু করেন। তিনি তার মা নুরজাহান বেগমকে, যিনি হাসনাবাদ গ্রামে ওয়েভ ফাউন্ডেশন পরিচালিত রূপালী মহিলা সমিতির একজন সদস্য, তাকেও নিয়মিত সঞ্চয়ের জন্য সহায়তা করতে থাকেন। মায়ের এ সঞ্চয়ের টাকা ও নিজের আয়বর্ধকমূলক কাজ থেকে অর্জিত মুনাফার টাকা বিনিয়োগ করে তিনি তার গৃহপালিত পশুপাখির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকেন। বর্তমানে তিনি ২৫টি হাঁস, ২২টি মুরগি, ৫টি ছাগল, ৩০টি কোয়েল পালন করছেন। এছাড়া পুকুরে মাছ চাষও অব্যাহত আছে। এসব কাজে কোনো সমস্যা হলে তিনি ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সাথে যোগাযোগ করেন এবং নিয়মিত পরামর্শ নেন।
উজ্জীবিত প্রকল্পের উপহার ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উজ্জীবিত হয়ে লাইলী আজ নিজেই আয়বর্ধকমূলক কাজে নিয়োজিত। সে এখন আর কারো বোঝা নয়। লাইলীর অগ্রগতিতে তার পরিবার-পরিজনের সবাই খুব খুশি। প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য লাইলী তাই এক দৃষ্টান্তের নাম।