পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার নিমহাওলা গ্রামের মাহিনুর আক্তার বিথীর নাম শুনলে এলাকাবাসীর চোখে ভেসে ওঠে পরিশ্রমী ও সংগ্রামী সফল এক নারীর চিত্র। জীবনযুদ্ধে যিনি বারবার হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু দমে যাননি। নিজ উদ্যমে হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী নারীর প্রতিচ্ছবি।

ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছার কৃষ্ণনগর গ্রামে মাহিনুরের শৈশব কেটেছে। বাবা আ. হামিদ মন্ডল ও মা হালেমন নেছার ছয় সন্তানের মধ্যে মাহিনুর ছিলেন সবার ছোট। তিনি মেধাবী ছাত্রী ছিলেন এবং স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। এসএসসি পরীক্ষার পর মাহিনুর পরিবারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। সেখানেই পরিচয় হয় রুহুল আমিন হাওলাদারের সঙ্গে, এবং ২০০৩ সালে তারা পারিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

বিয়ের পর ২০০৬ সালে তারা পটুয়াখালীর নিমহাওলা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। রুহুল নদীতে মাছ ধরতেন, আর মাহিনুর বাড়িতে গ্রামবাসীর ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। জীবনের দিনগুলো মোটামুটি চলছিল। ক্রমান্বয়ে তিন সন্তানের পিতা-মাতা হন তারা। সন্তান দেখভাল করার জন্য প্রাইভেট পড়ানো বাদ দেন তখন মাহিন। কিন্তু সন্তানদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরচও বাড়তে থাকে। সেই সময় মাহিনুর বুঝলেন, সংসারের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে, খুঁজতে থাকেন আয়ের নতুন পথ।

২০১৯ সালে মাহিনুরের জীবনে একটি নতুন সুযোগ আসে। সেসময় তাদের গ্রামে ওয়েভ ফাউন্ডেশন কর্তৃক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহায়তায় বাস্তবায়িত ‘পাথওয়েজ টু প্রসপারিটি ফর এক্সট্রিমলি পুওর পিপল (পিপিইপিপি)’ প্রকল্পের সদস্য বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়। মাহিনুর বেগম প্রকল্পের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নিয়মিত পিভিসিতে আসেন এবং সঞ্চয় জমা করতে থাকেন। ২০২১ সালে প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে নিজ উদ্যোগে তিনি শুরু করেন দেশি মুরগি পালন। তবে, অভিজ্ঞতার অভাব আর সঠিক পদ্ধতি না জানায় তার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়—মুরগিগুলো রোগে মারা যায়। সেই সময় তার ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। “ভাবছিলাম সব শেষ,” তিনি বলছিলেন। “কিন্তু প্রকল্পের কর্মকর্তারা আমাকে বোঝালেন, চেষ্টা করলে পারব। আমাকে প্রশিক্ষণ নিতে বললেন।”

প্রকল্প থেকে মুরগি পালনের ওপর দুইদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি একটি ছোট ব্রয়লার মুরগির খামার দেন। প্রশিক্ষণে শেখা পদ্ধতি অনুযায়ী সুষম খাবার, বাসস্থান ও চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা নেন। সঠিক খাদ্য, পরিচ্ছন্ন শেড আর নিয়মিত ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করে মুরগি পালন শুরু করেন। এবারে তিনি ভালো ফলাফল পেতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি সোনালী মুরগি পালনে মনোনিবেশ করেন। বর্তমানে  মাহিনুরের খামারে দুইটি শেডে ৮০০টি সোনালী মুরগি রয়েছে। এখান থেকে তিনি ২০–২৫ হাজার টাকা লাভের আশা করছেন। তার আঙিনায় এখন শুধু মুরগি নয়, সবজির ক্ষেতও রয়েছে। মুরগির বিষ্ঠা থেকে তৈরি জৈব সার সেই সবজিতে ব্যবহার করেন।

মাহিনুরের স্বামী রুহুল এখনও নদীতে মাছ ধরেন। তার মাসিক আয় ১৫–২০ হাজার টাকা। তাদের সংসার আর সেই আগের মতো নেই। মুরগি ও সবজি বিক্রি থেকে বাড়তি আয়ে সংসারে স্বচ্ছলত এসেছে। “জীবনে অনেক কঠিন সময় গেছে,” বলেন মাহিনুর। “কিন্তু নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল। আমি এখন জানি, চেষ্টা করলে সাফল্য আসবেই।”

কথাগুলো বলার সময় তার মেয়ে সুজানা আক্তার উঠানে খেলছিল আর মাহিনুর একপাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলেন। তার সেই হাসিতে ছিল এক ধরনের শান্তি—যে শান্তি আসে অনেক কঠিন পথ পেরিয়ে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর পর।

Contact Us

We're not around right now. But you can send us an email and we'll get back to you, asap.

Not readable? Change text. captcha txt