বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। দেশের উপকূলবর্তী ১৯টি জেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা, তীব্রতা ও প্রভাব প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন অক্সফ্যাম বাংলাদেশের সহযোগিতায় জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা লক্ষিত জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশেষ করে নারী ও যুব সম্প্রদায়ের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে প্রস্তুতি গ্রহণ এবং যুব নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে জলবায়ু ঘাত-সহিঞ্চু কমিউনিটি তৈরি করার লক্ষ্যে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় এশিয়া কমিউনিটির দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং রূপান্তর (Asia Community Disaster Preparedness & Transformation -ACT) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি জাগো নারী এবং এসকেএস ফাউন্ডেশন যথাক্রমে বরগুনা ও গাইবান্ধা জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত রয়েছে। এ কর্মসূচি বাংলাদেশ, নেপাল, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়াতে একসাথে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

প্রকল্পের বহুমুখী কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অক্সফ্যাম বাংলাদেশ ও ACT প্রকল্প বাস্তবয়নকারী সংস্থাসমূহের সহযোগিতায় গত ৪ অক্টোবর ২০২৩ পর্যটন কর্পোরেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, ঢাকায় দিনব্যাপী ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থাানীয় নেতৃত্ব’ শীর্ষক এক মার্কেট সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। এই সিম্পোজিয়ামের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় নেতৃত্বের ভূমিকা ও বিকাশ, কমিউনিটির সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তম চর্চা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়সহ কর্মসূচি থেকে অর্জিত বিভিন্ন অভিজ্ঞতাসমূহ বিনিময় এবং জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারকদের কাছে তুলে ধরা, যাতে করে স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি আরো শক্তিশালী হয়। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ভিত্তিক নেতৃত্বদানকারী দলসমূহকে অর্ন্তভুক্তিমূলক দুর্যোগ-পূর্ব ঝুঁকি নিরূপণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আইনসিদ্ধ স্থানীয় কাঠামো এবং মূলধারার কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা, যাতে তারা মাঠ পর্যায়ে দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় আরো ভালোভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেন।

সিম্পোজিয়ামের উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিক্স এবং খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এমপি। আয়োজকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী। এছাড়া বক্তব্য রাখেন অক্সফ্যাম বাংলাদেশের হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাকশন এন্ড ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্স’র প্রধান মো. আতোয়ার রহমান এবং সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ ও জাগো নারীর প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদানকারী বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য অংশীজন অংশগ্রহণ করেন।

সিম্পোজিয়ামে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. এনামুর রহমান এমপি বলেন, বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় ও যুব সমাজের জন্য নেতৃত্ব বিকাশ ও সক্ষমতা উন্নয়নে সরকার যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে রয়েছে, যে সকল স্থানে সাইক্লোন প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি (সিপিপি) ভলান্টিয়ার নেই সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় যুবদের মাধ্যমে ভলান্টিয়ারে কাজ পরিচালনা করা; সতর্ক সংকেত প্রচার করা; ঘূর্নিঝড় চলাকালীন সাইক্লোন শেল্টার ব্যাবস্থাপনার কাজ করা; স্থানীয় বয়স্কদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে সহায়তা করা; স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় শুকনা খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যাবস্থা করা। আয়োজকদের পক্ষে মহসিন আলী বলেন, সমগ্র পৃথিবী এখন উষ্ণ; প্রাকৃতিক – মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের ফলে ঘটছে জলবায়ু পরিবর্তন। আর এ পরিবর্তন মোকাবেলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসছে যুবরা। তাদের এ উদ্যোগ কার্যকরীকরণে স্থানীয় পর্যায়ের যুবদের ইউনিয়ন পরিষদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। মো. আতোয়ার রহমান বলেন, দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় নেতৃত্বের সক্ষমতা সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একযোগে এ লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে ইফতেখার মাহমুদ দুর্যোগ মোকাবেলায় তরুণ স্বেচ্ছাসেবক মডেল গঠনের কথা বলেন। এছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়, গণমাধ্যমের সচেতনতামূলক প্রচারণা দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি অগ্রসর ভূমিকা পালন করছে। হোসনে আরা হাসি বলেন, দুর্যোগ বিষয়ে সরকার ও স্থানীয় সরকারকে মনিটরিং এর দিকে আরও নজর দিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আরও বেশি পদক্ষেপ নেয়া গেলে দুর্যোগ অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে দুর্যোগ-পূর্ব প্রস্তুতি ও দুর্যোগকালীন সাড়াদান। বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি তরুণদের অংশগ্রহণের হার ২৮.২%।

স্বেচ্ছাসেবক, বিশেষ করে নারী স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে দুর্যোগকালে মৃত্যুসহ দুর্যোগের সাধারণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমছে। সভাপতির বক্তব্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, শুধুমাত্র দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নয়, সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে তারা নিজেদের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অবশ্যই তাদের মানবিক মূল্যবোধও সৃষ্টি করতে হবে। একইসাথে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণ ও প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

এছাড়া দিনব্যাপী এ আয়োজনে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রস্তুতি শক্তিশালীকরণ ও সরকারের ভ‚মিকা’ এবং ‘তৃণমূলে দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় অন্তর্ভুক্তি ও উত্তম চর্চা’ নামে দুটি প্লেনারি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ সকল অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক নিতাই চন্দ্র দে সরকার, বিডিআরসিএস এর উপ-পরিচালক মো. নুরুল আমিন, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন সিকদার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক আহমেদুল হক, ন্যাশন্যাল এলায়েন্স অব হিউম্যানিটারিয়ান এক্টরস বাংলাদেশ নেটওয়ার্কের সাবেক সভাপতি ড. এম এহসানুর রহমান, ক্লাইমেট এন্ড কোস্টাল জার্নালিস্ট রফিকুল ইসলাম মন্টুসহ সংশ্লিষ্ট আরও অনেকেই বক্তব্য রাখেন। এছাড়া বরিশাল, বরগুনা ও গাইবান্ধা জেলা থেকে আগত যুব প্রতিনিধি মাহাদী ইসলাম, হেদায়েদ উল্লাহ ও শান্তা ইসলাম এবং সিবিও লিডার লাভলী বেগম, নুরুন্নাহার বেগম ও মো. আরিফুর রহমান স্থানীয় পর্যায়ের দুর্যোগ মোকাবেলায় তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। দিনব্যাপী সিম্পোজিয়াম শেষে আয়োজক সংস্থার পক্ষে অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-নির্বাহী পরিচালক নাসিফা আলী।

উদ্বোধনী ও দুটি প্লেনারিতে উপস্থিত আলোচকবৃন্দের বক্তব্য থেকে শিক্ষণীয় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে:

  • বহুমুখী সাইক্লোন সেন্টার তৈরি করতে হবে;
  • দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে;
  • দুর্যোগের পরবর্তী সময়ে ত্রাণ বিতরণে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে;
  • নিয়মিত মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা;
  • দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় সম্ভাব্য আগাম সতর্কতা ও প্রচারণা বৃদ্ধি করা;
  • কমিউনিটির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উপকরণ সহায়তা প্রদান করা;
  • দুর্যোগ প্রস্তুতি, সাড়া প্রদান ও পুনরুদ্ধারে নারী, যুব ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা;
  • দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান;
  • উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন বৃদ্ধি করা।
Contact Us

We're not around right now. But you can send us an email and we'll get back to you, asap.

Not readable? Change text. captcha txt