দিনের শুরুতে সূর্যের প্রথম আলো যখন ভেজা ঘাসের উপর পড়ে, তখন তা যেমন ঝিকমিক করে ওঠে, আমার জীবনও তেমনই ঘাস চাষের মাধ্যমে সাফল্যের আলোকিত পথে পা বাড়িয়েছে। প্রতিদিনের নতুন সূর্যের মতো আমার জীবনেও নতুন আশার আলো ফুটে উঠেছে। একসময় সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম। প্রবাসের পথের সামান্য শ্রমিক থেকে আমি আজ একজন স্বাবলম্বী চাষী। প্রতিনিধিত্ব করে চলেছি দেশের কৃষক সমাজের।
আমি মো. লিটন মিয়া। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, কিন্তু জীবনে বড় কিছু করার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন নিয়ে একসময় সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাই। তবে সবসময়ই মনে হতো, নিজের দেশে ফিরে কিছু করতে হবে, কিছু সৃষ্টি করতে হবে। ২০১৮ সালে সেই তাগিদেই দেশে ফিরে আসি। ফিরে এসে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম, কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, কীভাবে নতুন কিছু শুরু করবো। ঠিক তখনই আমার এক আত্মীয় আমাকে পরামর্শ দিলেন কাঁচা ঘাসের চাষ শুরু করতে। প্রথমে সন্দিহান ছিলাম, কিন্তু একটু যাচাই করে দেখলাম, কাঁচা ঘাসের চাহিদা বেশ ভালো। একবার চাষ করলে পাঁচ থেকে সাত বছর ঘাস পাওয়া যায় এবং ঠিক ভাবে করতে পারলে ব্যবসাটাও লাভজনক। প্রথমে ৩৩ শতক জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ শুরু করি। ঘাস চাষ শুরু করার পর নিজেই দেখতে পাই, চাহিদা কেমন দ্রুত বাড়ছে। নিজের গরুকে খাওয়াই, আবার বিক্রিও করি। সেই থেকে শুরু হলো আমার নতুন যাত্রা।
২০২২ সালের মার্চ মাসে ইফাদ (আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল), ডানিডা (ডেনিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিস) ও পিকেএসএফ (পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন) এর আর্থিক সহযোগিতায় এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশনের বাস্তবায়নে আরএমটিপি (রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট) প্রকল্পের মাধ্যমে আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেল। আরএমটিপি প্রকল্পের আওতায় আমাকে ঘাস চাষী উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। প্রকল্প থেকে আমাকে ঘাস চাষের ওপর এক দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ এবং আর্থিক সহায়তায় আমি ঘাস চাষে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠলাম। আরএমটিপির কৃষি অফিসারের পরামর্শে প্রতি বছর নেপিয়ার ঘাসের চাষ বাড়াতে থাকি।
বর্তমানে আমি ১৩২০ শতক জমিতে ঘাস চাষ করছি। এর মধ্যে ৮০০ শতক জমি লিজ নিয়েছি এবং ৫২০ শতক জমি আমার নিজের। প্রতিমাসে ৭০ থেকে ৮০ টন ঘাস বিক্রি করি, যার বাজারমূল্য প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। উৎপাদন খরচ এবং জমি লিজের খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো লাভ হয়। আরএমটিপি প্রকল্প থেকে পনের হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিলাম, যা দিয়ে আমার ঘাস বিক্রির দোকানটি সাজিয়েছি। এখন একটি পিকআপ গাড়ি কিনেছি, যাতে করে বিভিন্ন বাজারে ঘাস সরবরাহ করতে পারি। আমার ঘাসের চাহিদা এখন পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আরএমটিপির কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঠ দিবস, রেডি ফিড ক্যাম্পেইন, এবং মাল্টি স্টেকহোল্ডার কমিটির সভায় অংশগ্রহণ করে আমার ঘাস বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আমি মেহেরপুর জেলা মাল্টিস্টেকহোল্ডার কমিটির একজন সদস্য। প্রতিবছর সংসার চালিয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতক জমি কিনছি। লিজ নেওয়া জমি ছেড়ে নিজের কেনা জমিতে ঘাস চাষ করছি, এতে উৎপাদন খরচও কমে যাচ্ছে। ঘাস চাষের লাভের টাকা দিয়ে আমি এখন নিজের জমি ৭৬০ শতক করেছি, দুই ছেলেকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি এবং গ্রামে একটি সুন্দর দুইতলা বাড়ি তৈরি করেছি। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা আমার ঘাস চাষ দেখতে আসেন, আমার বাড়িতে আসেন, আমার ঘাসের কাটিং নিয়ে যান। আজ আমি একজন সফল ঘাস ব্যবসায়ী। এই সফলতার পেছনে রয়েছে ওয়েভ ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফ, ডানিডা এবং ইফাদের সহযোগিতা। তাদের সহায়তা ছাড়া আমি এতদূর আসতে পারতাম না, তাদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।
এই দীর্ঘ যাত্রায়, ওয়েভ ফাউন্ডেশন ও এর সহযোগী সংস্থাগুলি আমাকে শুধু আর্থিক সহায়তা করেনি, তারা আমাকে আত্মবিশ্বাস এবং আশা দিয়েছে। তাদের এই উদ্যোগ আমাকে ও আমার পরিবারের জীবন বদলে দিয়েছে এবং গ্রামের মানুষদের কাছে আমার সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়েছে। আজ আমার গল্প শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত সাফল্যের নয়; এটি একটি জ্বলন্ত প্রমাণ যে, সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে জীবন বদলানো সম্ভব। ওয়েভ ফাউন্ডেশন এবং এর সহযোগী সংস্থাগুলির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অপরিসীম।