গত ১৬ জুলাই ২০২৪, রাজধানীর সিক্স সিজনস হোটেলে ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তারা বলেন, বাজেটে ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির চাপে হিমশিম খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে প্রকৃত উপকারভোগীর বিশাল একটা অংশ এখনও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় আসতে পারেনি। প্রকৃত উপকারভোগীদের সঠিক তালিকা না থাকা, শিক্ষার অনগ্রসরতা, জবাবদিহিতার অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, স্বজনপ্রীতি, লিঙ্গ বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অভাব, নিয়মিত মনিটরিং না করা প্রভৃতি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার অন্যতম কারণ।
ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী’র সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ এডভোকেট সানজিদা খানম এমপি, বিশেষ অতিথি হিসেবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল; মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জাকিয়া আফরোজ; এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মো. আনোয়ার হোসেন এবং ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন উপস্থিত ছিলেন। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন ও সঞ্চালনা করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা। এছাড়াও এতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, এডভোকেসি নেটওয়ার্ক কমিটি, নাগরিক সমাজ, যুব ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। সভাপতির বক্তব্যে মহসিন আলী বলেন, “মূলধারার আমরাই দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হিজড়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে আসলে পিছিয়ে রাখি। কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রও পিছিয়ে রাখে। হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য প্রয়োজনীয় আইন দরকার। সামাজিক সুরক্ষাসহ সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য দরকার সুশাসন নিশ্চিত করা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সরকারকেই প্রথমে তৎপর হতে হবে, নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে, সোচ্চার হতে হবে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় বাস্তবায়িত ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ (ইএলএমসি)’ প্রকল্প আয়োজিত এ মতবিনিময় সভায় মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত সামাজিক নিরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করেন গবেষক আহমেদ বোরহান। সামাজিক নিরীক্ষার ফলাফলে যে সুপারিশগুলো উঠে এসেছে সেগুলো হলো: বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও নিম্নবিত্তদের জন্য স্বল্পমেয়াদী (যেমন, রেশনিং) ও দীর্ঘমেয়াদী (যেমন, মূল্য কমিশন প্রতিষ্ঠা) পদক্ষেপ গ্রহণ করা; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট নতুন দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্ত করা; নগর দরিদ্রদের জন্য বেশি বরাদ্দের পাশাপাশি নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা; সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিসমূহের উপকারভোগীদের ডিজিটালাইজড নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সেবা প্রদান বিষয়ে ন্যূনতম জানাবোঝার ব্যবস্থা করা; পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি প্রভৃতি খাত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে না রাখা; কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং সেবাগ্রহীতাদের উত্তরণে একটি সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনাসহ শক্তিশালী মনিটরিং ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত করা; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহের ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা (জিআরএস) সহজতর ও কার্যকর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ভিজিডি, প্রতিবন্ধী ও হিজড়া ভাতা গ্রহণকারীদেরকে সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে আরো বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করা; প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাঠামোগত বাধা (আইসিইউ, অ্যাম্বুলেন্স, টয়লেট ইত্যাদি), মানবসম্পদের ঘাটতি ইত্যাদি পূরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা; হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ ও হয়রানিমুক্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা; সামাজিক সুরক্ষাসহ সরকারি বিভিন্ন সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রচারের জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনসমূহের সহায়তা গ্রহণ এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোরও এ সংক্রান্ত প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখা।