“সীমা দিনকে দিন সেয়ানা হয়ে উঠছে, তার বিয়ে-সাদিটা এখনি দিয়ে দিয়া দরকার। সে এক ক্লাস-দু’ক্লাস কইরি, নয়-নয়খান ক্লাস পাড়ি দিয়া ফালাইছে, তাই চাচ্ছি আমার ভাতিজা মুরাদের সাথে ওর বিয়াডা সাইরে দিই।” এসব বলে সীমার খালু মোতালেব প্রতিনিয়ত তার মা-বাবাকে প্রচন্ড চাপ দিতে থাকে। সব শুনে সীমার মা বলেন, “যা ভালো বুঝেন, তাই করেন।”
কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ‘কৈপাল’। সেই গ্রামের নিঃসন্তান দম্পতি ভ্যানচালক মোখলেছ বিশ্বাস ও শেফালী খাতুনের পালিত মেয়ে কিশোরী সীমা খাতুন। মোখলেছ-শেফালী দম্পতির পারিবারিক অবস্থা তেমন ভালো না। ভ্যান চালিয়ে আর সামান্য ফসলী জমিতে চাষ করে চলে তাদের সংসার। সীমা এখন ক্লাস নাইনে। পড়া-শোনা, সুন্দর হাতের লেখা আর সাবলীল উপস্থাপনায় ‘সীমা অন্য দশ জনের চেয়ে এগিয়ে’। সীমার স্বপ্ন বড় পুলিশ অফিসার হয়ে জনসাধারণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। কৈশোর কর্মসূচির আওতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশন কৈপাল গ্রামে ২০১৯ সালে গড়ে তোলে কিশোরী ক্লাব, যেখানে সীমা সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক।
সীমা বড় হয়েছে, এখনই তার বিয়ে দেয়া দরকার বলে ব্যতিব্যস্ত খালুর পাল্লায় পড়ে হঠাৎ একদিন সীমা পাত্রপক্ষের সামনে যেতে বাধ্য হয়। সীমাকে দেখে পাত্রপক্ষের পছন্দ হলে, ঐদিনই তারা বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চায়। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ এই দিনে ১৬ বছর বয়সী সীমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। যেন মুহূর্তেই তার স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে আসে। এদিকে ক্রমেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে আর সীমাও জেদ ধরে বসে থাকে, সে কোনমতেই বিয়ে করবে না। কিশোরী ক্লাবে সীমা শপথ নিয়েছিলো, বাল্য বিবাহ রুখবে, কিশোরীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। আজ সে নিজেই বাল্য বিয়ের শিকার হতে যাচ্ছে! এসব ভাবতে ভাবতেই সীমার সামনে দেওয়া হয় সাদা একটি কাগজ, যাতে মোটা কালী দিয়ে লেখা রয়েছে “নিকাহনামা”। সবাই বলতে থাকে, ছেলে সই করে দিয়েছে। এবার সীমা সই করলে এবং মুখে সম্মতি দিলেই বিয়ে হয়ে যাবে। শুরু হয় সীমার প্রচন্ড কান্না-কাটি। সীমার খালু বলেন, “তোমরা জন্ম নিবন্ধনের বয়স বাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা কর, দিন পনেরো পরে অনুষ্ঠান করে বউ উঠিয়ে দিলেই হবে। এর মাঝে সীমাকে বুঝিয়ে সই করে নিও তোমরা।” সীমা পরদিন সকালেই অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ কিশোরী ক্লাবে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলে। ঠিক তার কয়েকদিন পর ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ওয়েভ ফাউন্ডেশন-এর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় বাল্য বিবাহ প্রতিরোধমূলক আলোচনা সভা। সেখানে ছয়টি কিশোর-কিশোরী ক্লাবের ৩০জন সদস্যসহ আমন্ত্রিত হয়ে আসেন দৌলতপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোছা. শারমিন আক্তার; দৌলতপুর থানার পুলিশ অফিসার নিশিকান্ত সরকার (ওসি, তদন্ত); কৈশোর কর্মসূচির ফোকাল পার্সন কামরুজ্জামান যুদ্ধ, সাংবাদিক ওয়াজেদ আলীসহ (ডি.বি.বার্তা) গণ্যমান্য অভিভাবকবৃন্দ। সেখানে উপস্থিত সীমাসহ তার ক্লাবের সদস্যরা উপস্থিত অতিথিদেরকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। সব শোনার পর ইউএনও-এর নির্দেশে পুলিশ অফিসার সীমার জবানবন্দি গ্রহণ করে তার বাড়ির ঠিকানা নেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পরের দিন ২৩ সেপ্টেম্বর পুলিশ কর্মকর্তা সীমাদের বাড়িতে যান এবং তার পরিবারকে বলেন, “আপনারা বাল্য বিবাহের মত যে আইনবিরোধী কাজ করতে যাচ্ছিলেন, সেটি পুনরায় করার চেষ্টা করলে হাতকড়া পরতে হবে পরিবারের সকলকে।” ভয় পেয়ে যায় সীমার পরিবার এবং কথা দেন যে, এই ঘৃণ্য কাজ তারা আর করবে না। সীমা উপস্থিত সবার সামনেই সেই নিকাহনামাটি ছিড়ে ফেলে। বাল্য বিবাহের ভয়াল গ্রাস থেকে বেঁচে যায় সীমা।
তাই দৃঢ়স্বরে বলা যেতেই পারে, আজকের সীমারাই পারবে সমাজের সকল বাল্য বিবাহ রোধ করতে; সকল প্রকার অসামাজিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।